• অমিতাভ বচ্চনের জীবনের ভয়াবহ সেই অধ্যায়: ‘কুলি’ শুটিং সেটে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ও নাটকীয় প্রত্যাবর্তন

তারিখ: ২৬ জুলাই ১৯৮২। এক দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে ধাক্কা দিয়েছিল গোটা ভারতকে। শুটিং চলাকালীন গুরুতরভাবে আহত হন বলিউডের ‘শাহেনশাহ’ অমিতাভ বচ্চন। সেই স্মরণীয় ও বেদনার অধ্যায় এখনও রয়ে গেছে বলিউড ইতিহাসের পাতা জুড়ে।

স্মিতা পাতিলের দুঃস্বপ্ন যেন বাস্তব একদিন আগেই, অর্থাৎ ২৫ জুলাই রাতে অমিতাভ বচ্চনের হোটেল রুমে


একদিন আগেই, অর্থাৎ ২৫ জুলাই রাতে অমিতাভ বচ্চনের হোটেল রুমে

বারবার বেজে ওঠে ফোন। ওপাশে অভিনেত্রী স্মিতা পাতিল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, “তুমি ঠিক আছ তো?” কারণ, তিনি একটি বাজে স্বপ্ন দেখেছিলেন অমিতাভকে নিয়ে। তখনও কেউ জানত না, ওই দুঃস্বপ্নই বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছে।

পরদিন, ২৬ জুলাই ১৯৮২। বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ‘কুলি’ ছবির মারামারির দৃশ্যের শুটিং চলছিল। সেই দৃশ্যে নবাগত অভিনেতা পুনীত ইসারের একটি ঘুষি ভুলভাবে গিয়ে পড়ে অমিতাভের পেটে। সেই আঘাতে তাঁর অন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হয়। একটি টেবিলের ওপর পড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সময়ের সামান্য বিচ্যুতি মরণফাঁদে পরিণত হয়।

প্রথমে তাঁকে নেওয়া হয় বেঙ্গালুরুর সেন্ট ফিলোমেনা হাসপাতালে। সেখানেই হয় জরুরি অস্ত্রোপচার। পরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে এনে ভর্তি করা হয় মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। অবস্থার অবনতির মধ্যে ২ আগস্ট কয়েক মিনিটের জন্য থেমে যায় তাঁর হৃদস্পন্দন। তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তখনই চিকিৎসক ড. ওয়াদিয়া শুরু করেন শেষ প্রচেষ্টা। একে একে প্রায় ৪০টি কর্টিসন ও অ্যাড্রেনালিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। এরপর ধীরে ধীরে সাড়া দিতে শুরু করে অমিতাভের দেহ। পাশে থাকা স্ত্রী জয়া বচ্চন কেঁদে ওঠেন—“দেখো, ও বেঁচে আছে! ওর পায়ের আঙুল নড়েছে।”

অমিতাভের সুস্থতার জন্য দেশজুড়ে শুরু হয় প্রার্থনা। হাজার হাজার মানুষ তাঁদের প্রিয় অভিনেতার সুস্থতা কামনায় মন্দির, মসজিদ, গির্জায় ছুটে যান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতালে এসে তাঁর কপালে চুমু দেন। রাজীব গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করে ফিরে আসেন মুম্বাই। কেউ কেউ নিজের অঙ্গ দান করতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিলেন।

এই ঘটনাকে মাথায় রেখে পরিচালক মনমোহন দেশাই বদলে দেন ‘কুলি’র কাহিনি। মূল গল্পে যেখানে নায়ক মারা যেত, সেখানে পরিবর্তন এনে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এমনকি সিনেমার সেই দৃশ্যে বিশেষভাবে জানানো হয়—এখানেই শুটিংয়ে আহত হয়েছিলেন অমিতাভ।

যে ঘুষিতে আহত হয়েছিলেন অমিতাভ, সেই ঘুষি দেওয়া পুনীত ইসার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সুস্থ হওয়ার পর নিজেই অনুরোধ করেন পুনীতকে হাসপাতালে আনতে। তাঁকে জড়িয়ে ধরে সবকিছু স্বাভাবিক করে দেন অমিতাভ।

এই দুর্ঘটনার জের অনেকদিন ছিল। রক্ত দেওয়ার সময় হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, যা ২০০০ সালে ধরা পড়ে। এতে তাঁর লিভারের ৭৫ শতাংশ নষ্ট হয় এবং আজীবন লিভার সিরোসিসে ভুগছেন অমিতাভ।

মাত্র ২১ বছর বয়সে অমিতাভের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন পুনীত। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর ছয় বছর কাজ পাননি। সবাই তাঁকে খলচরিত্রে রূপান্তরিত করে দেন। পরে ‘মহাভারত’-এ দুর্যোধনের ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ফের আলোচনায় আসেন। তবে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয় সেই সময়টা।

সবকিছুর পর, ১৯৮৩ সালের ৭ জানুয়ারি আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান অমিতাভ বচ্চন। যেন কিছুই হয়নি। ফিরে আসেন নিজস্ব জাদুকরী ভঙ্গিতে।

মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালের ২ ডিসেম্বর। সাড়ে তিন কোটি রুপির বাজেটে নির্মিত সিনেমাটি ব্যবসা করে ২১ কোটিরও বেশি। বছরের সবচেয়ে সফল ছবি হয়ে ওঠে এটি।


এই দুর্ঘটনা শুধুই এক অভিনেতার নয়, পুরো দেশের আবেগ, ভালোবাসা ও সংকল্পের এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে আছে। অমিতাভ বচ্চনের জীবনের এই অধ্যায় আজও লাখো ভক্তের চোখে জল এনে দেয়।